ইতিহাসের প্রথম মাদরাসা | The first Madrasa in history

The first Madrasa in history


জ্ঞানার্জনের জন্য ইসলামের প্রাথমিক যুগে তেমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কোন মাদরাসা ছিল না। ইসলামের আদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল মসজিদ। এক রেওয়াতে আছে, হযরত আদম আ. দুনিয়াতে এসে বাইতুল্লাহ বা পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেন। এটিই মানব জাতির প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 


নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহী ওয়া সাল্লাম ইসলাম প্রচারের সূচনা থেকেই মানব জাতির মহান শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি ইসলাম শিক্ষার নিয়মনীতি প্রবর্তন করেন। তিনি নবুওয়্যাত লাভের পর কাবাকে প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেন। 


তবে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। পরে তিনি মক্কা নগরীর সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আরকাম বিন আবুল আরকামের বাড়িতে ‘দারুল আরকাম’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ইতিহাসের প্রথম মাদরাসা মক্কা নগরীর আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রা.)এর বাড়ির দারে আরকামে প্রতিষ্ঠিত হয়।

★ আল আরকামের অবস্থান 
মক্কায় কুরাইশ পৌত্তলিকদের অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকে। তখনো মুসলমানগণ শান্তিতে উপসনা করতে পারছিলো না। সাফা পর্বতের পূর্বে আল আরকামের বাড়ি জমায়েতের জন্যে নিরাপদ ছিলো। সেখানে সবাই মিলিত হয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া সাল্লামের কাছে ইসলামের শিক্ষা নিতেন।


বাড়ির সামনের পথ খুবই সরু হওয়ায় বাড়ির ভেতরে গোপনে প্রবেশ এবং বের হওয়া যেতো। বাড়ির ভেতর থেকে পথের উপর নজর রাখা যেতো। ইসলাম প্রচারের ৫ম বছরে আরকামের রা. গৃহ ইসলামের ঘর নামে পরিচিতি পায়। এটিই প্রথম ইসলামী মাদরাসা হিসেবে স্বীকৃত। যেখানে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া সাল্লাম ছিলেন শিক্ষক, প্রথম মুসলমানগন ছিলেন শিক্ষার্থী।


★ দারুল আরকামের বিশিষ্ট ছাত্রগন
হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. হজরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. হজরত উসমান ইবনে আফফান রা. হজরত আলী ইবনে আবি তালিব রা. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. মুসআব ইবনে উমাইর রা. আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. সহ প্রথম শ্রেণীর সাহাবায়ে কেরামগন এখানকার উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন।


★ দারুল আরকামের শিক্ষাব্যবস্থা
দারুল আরকামই ইসলামের প্রথম আনুষ্ঠানিক মাদরাসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া সাল্লাম নিজেই এখানে দ্বীনী তালীম দানে নিয়োজিত ছিলেন। যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই শিক্ষক ছিলেন সেখানের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। 


★ দারুল আরকামের কার্যক্রম
দারুল আরকামে একই সাথে দ্বীনী তালীম অর্থাৎ আদব-আখলাকের তালীম, ঈমানের দাওয়াত, কুরআনের শিক্ষা প্রদান করা হতো। নবুয়তের প্রথমদিকে বিশেষত্ব মাক্কী জীবনে ইসলামের বুনিয়াদি জ্ঞান ও ইবাদতের নিয়মকানুন শিক্ষা গ্রহণই পাঠ্যভুক্ত ছিল। 

এ সময়কার পাঠ্যসূচিতে পবিত্র কুরআনকেই প্রধান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তা ছাড়া কিছুসংখ্যক সাহাবিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া সাল্লাম পবিত্র কুরআনের লিপিকার হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার জন্য তাদের হস্তলিপি বিশারদ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। হযরত উমর রা. এর ইসলাম গ্রহণকালে তার বোন ফাতেমার রা. কাছে সূরা ত্ব-হার লিখিত হস্তলিপি পাওয়া গিয়েছিল।

★ দারুল আরকামের ওস্তাদগন
মদিনায় হিজরতের আগে আকাবার শপথের মাধ্যমে যারা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তাদের প্রশিক্ষিত করতে তিনি হযরত মুসআব ইবনে উমাইর রা.-কে মদিনায় পাঠান। 


মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া সাল্লামের হিজরতের সময় দারুল আরকামে শিক্ষাদানের জন্য হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. ও মুসআব ইবনে উমাইর রা. এর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। হিজরতের পর মক্কায় অবশিষ্ট মুসলমানদের মধ্যে দারুল আরকামের মাধ্যমেই দাওয়াতে ইসলামের কর্মকাণ্ড জারি রাখা হয়।


★ দারুল আরকামে ইসলাম গ্রহণ
নতুন ইসলাম গ্রহণকারীদের আল-আরকামের গৃহে আনা হতো। প্রচারের ষষ্ঠ বছরে (৬১৫-৬১৬ খ্রিষ্টাব্দ) দুজন ক্ষমতাশালী কুরাইশ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া সাল্লাম এর চাচা হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং উমর ইবনুল খাত্তাব এই মাদরাসায় এসে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। 


উমর রা. ইসলাম গ্রহণে মুসলমানের সংখ্যা ৪০ উত্তীর্ণ হয়। এ দলটি সারাবিশ্বে ইসলাম প্রসারের উদ্যোগ নেয়। এছাড়া শুহাইব ইবনে সিনান রুমি, আম্মার ইবনে ইয়াসির সহ বহু সাহাবী এই মাদরাসায় এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।


★ বর্তমানে মাদরাসার অবস্থা ও অবস্থান 
আল আরকাম তার পুত্রকে এই শর্তে বাড়িটি দেন যে সে এটা বিক্রি করবেনা। আরকামের এ বাড়িটি ছিল সাফা পাহাড়ের পাদদেশে। সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে তাওয়াফ করার সময় ঠিক বাড়িটির দরজার সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে হতো। আব্বাসী খলিফা মানসুরের সময় ১৪০ হিজরি পর্যন্ত বাড়িটি অবিকৃত অবস্থায় ছিল। 


কিন্তু এ বছরই মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হাসান মদিনায় আব্বাসী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আরকামের পৌত্র আবদুল্লাহ ইবন উসমানও ছিলেন এ বিদ্রোহের একজন সমর্থক ও সহযোগী। এ কারণে খলিফা আল মানসুরের নির্দেশে মদিনার তৎকালীন ওয়ালী তাকে গ্রেফতার করেন। খলিফা মানসুর তার বিশ্বস্ত সহকারী শিহাব উদ্দিন ইবনে আবদে বরকে পাঠালেন আবদুল্লাহর নিকট এই বাড়িটি ক্রয়ের প্রস্তাব দিয়ে। 


আবদুল্লাহ প্রথমত বিক্রী করতে অস্বীকার করেছিলেন কিন্তু কয়েদ থেকে মুক্তির শর্তে এবং উচ্চ মূল্যের লোভে শেষ পর্যন্ত বিক্রী করতে সম্মত হন। আল মানসুর ১৭,০০০ দিনারের বিনিময়ে এ ঐতিহাসিক বাড়িটির মালিকানা লাভ করেন। বাড়িটির অন্য শরীকরা প্রথমত রাজী না হলেও পরে তারাও রাজী হয়ে যান। 


খলিফা মানুসরের পর খলিফা মাহদী এ বাড়ীটি তাঁর প্রিয়তমা দাসী খায়যুরানকে দান করেন। তিনি বাড়িটির পুরনো কাঠামো ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন অট্টালিকা তৈরী করেন। এবং বাড়িটি এখন দারুল খায়জুরান নামে পরিচিত। বর্তমানে এটা কাবার বিপরীত পাশে অবস্থিত এবং একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.