সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ) || উপমহাদেশের অন্যতম আলেমেদ্বীন

syed-rshad-madani-ne-scholars-subcontinent




দারুল উলুম দেওবন্দের সিনিয়র মুহাদ্দিস, জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের মহামান্য সভাপতি, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল'বোর্ড এর অন্যতম সদস্য, মাওলানা সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)। যাকে এই উপমহাদেশের সর্বোচ্চ ইসলামী চিন্তাবিদ, ধর্মীয় নেতা ও দেওবন্দী আলেমগণের ইলমী উত্তরাধিকারের আমির বলা হয়ে থাকে। আজ আলোচনা করবো সেই মহামানব সম্পর্কে।


জন্ম এবং শিক্ষা জীবন
মাওলানা সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী 1360 হিজরী, মোতাবেক 1941 ইংরেজী সালে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন 1946 সালে মাওলানা ক্বারী আসগর আলী (র:) এর নিকট ৷ যিনি হযরত মাদানী খলিফা ছিলেন৷ তিনি আট বৎসর বয়সে কুরআনুল কারীম সম্পূর্ণ মুখস্থ করেন ৷ সর্ব প্রথম খতমে তারাবীহ পড়ান বাঁশকান্দী, আসাম ৷ স্বীয় পিতা হযরত মাদানীর (রা:) এর উপস্থিতিতে।


দারুল উলূম দেওবন্দের প্রচলিত প্রথানুযায়ী পাঁচ বছরে ফারসী শিক্ষা সমাপ্ত করে 1955 সালে আরবী শাখায় শিক্ষা শুরু করেন। দারুল উলূম দেওবন্দে 1959 সালে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ভর্তি হন৷ পারিবারিক মুরব্বী জ্যেষ্ঠভ্রাতা মাওলানা সায়্যিদ আস' আদ মাদানী তৎকালীন বিখ্যাত আরবী সাহিত্যিক মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভী কে দিল্লী থেকে সায়্যিদ আরশাদ মাদানীকে আরবী ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা দানের জন্য দেওবন্দে ডেকে পাঠান৷ 


হযরত মাওলানা কিরানভী প্রায় তিন বৎসর পর্যন্ত তাঁকে আরবী ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা দেন৷ অতঃপর শাইখ আব্দুল ওয়াহহাব , মাহমুদ আব্দুল ওয়াহহাব (মিশর) এর নিকটেও দুই বৎসর উচ্চতর আরবী ভাষা ও সাহিত্যের প্রশিক্ষণ নেন৷ সাথে সাথে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী দেওবন্দের স্বনামধন্য শিক্ষকমন্ডলী থেকে শিক্ষা লাভ করতে থাকেন ৷ 1963 সালে তিনি দাওরায়ে হাদীস পাশ করে শিক্ষা সমাপ্তির সনদ অর্জন করেন।


সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)'এর শিক্ষকবৃন্দ
১. ফখরুল মুহাদ্দিসীন হযরত মাওলানা সায়্যিদ ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী (রা:)
২. হযরত শাইখুল আদব মাওলানা ইজাজ আলী (রা:)
৩. আল্লামা ইব্রাহীম বলিয়াভী (রা:)
৪. হযরত মাওলানা জলিল আহমদ কিরানভী (রা:)
৫. হযরত মাওলানা আখতার হোসাইন দেওবন্দী (রা:)
৬. হযরত মাওলানা ওয়াহীদুজ্জামান কিরানভী (রা:) প্রমুখ;


সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)'এর বাই' আত ও খিলাফত
শিক্ষা জীবন শেষ করার পর আধ্যাত্মিকতার দুর্গম পথে পা রাখলেন ৷ তাঁর বড় ভাই ফিদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আস' আদ মাদানী (রা:) এর নিকট বাই' আত হয়ে তার হিদায়ত ও প্রদর্শিত পথেই চলতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই ইজাজতে বাই' আত, খিরকায়ে খিলাফত নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতা থেকে অর্জন করেন৷


সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)'এর কর্মজীবন 
সর্ব প্রথম কর্মজীবনের সূচনা 1965 সালে বিহার প্রদেশের প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া কাসিমিয়া গয়ায় শিক্ষক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন৷ 1969 সালে দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস এবং তৎকালীন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা সায়্যিদ ফখরুদ্দীন সাহেব (রা:) এর হুকুমে "জামিয়া কাসিমিয়া মাদরাসা শাহী মুরাদাবাদে যোগদান করেন৷ 


1971 সালে হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন (রা:) তার পরিচালনার দক্ষতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে শিক্ষা কমিটির কনভেনার এবং 1972 সালে সহকারী শিক্ষা সচিব হিসাবে নিয়োগ দেন৷ তখন মাওলানা ফখরুদ্দীন (রা:) শিক্ষা সচিব ছিলেন৷


1982 সালে দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শুরার আহবানে মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন৷ ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষা সচিব ছিলেন৷ তিনি তার দায়িত্ব পালনকালে যারপরনাই মেহনত করে হিফজ্ বিভাগ, ক্বীরাত বিভাগ, প্রাথমিক আরবী বিভাগ সমূহ অতুলনীয়ভাবে বড় যত্ন করে গড়ে তুলেছেন৷


সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)'এর রাজনৈতিক জীবন
জুলাই 1984 সালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন৷ 2006 সালে হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রা:) এর মৃত্যুর পর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি নির্বাচিত হন৷ তিনি অদ্যাবধি এ পদে সমাসীন রয়েছেন। সমস্ত বিশ্বে বিশেষ করে হিন্দুস্তানে তাহার নেতৃত্বেই জমিয়তের কাজ দিনের পর দিন আরো বেগবান হচ্ছে। তিনি ভারতের মুসলমানদের একক পথ প্রদর্শন হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন।


সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)'এর রচনাবলী
১. সর্বপ্রথম 1980 সালে হিন্দী ভাষায় কুরআনুল কারীমের তাফসীর লিখার কাজ আরম্ভ করেন এবং দু' খন্ডে 1991 সালে সম্পন্ন করেন ৷
২. 722 পৃষ্ঠার দু' খন্ডে বিভক্ত ফিকহে্ হানাফির ইকদুল ফারায়িদ ফি তাকমীলে কায়দিস্ শারাইদ মারুফ বি- শারহি মানজুমাহ ইবনে ওহ্বান এর পান্ডুলিপি নিজে পরিমার্জন ও সংশোধন করতঃ সর্বপ্রথম প্রকাশ করেছেন ৷
৩. জগৎবিখ্যাত মুহাক্কিক আলেম হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী (রা:) এর অনুপম অবদান " নুখাবুল আফকার ফি তানকীহে মাবানীল আখবার ফি শরহে মা' আনীল আছার " (ত্বহাবী শরীফ) এর হস্ত লিখিত পান্ডুলিপি মিশরের আল - আজহার লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করতঃ সংশোধন পরিমার্জন করে প্রকাশের কাজ শুরু করেন, যা আল্লাহ তা' আলার মেহেরবানীতে আট হাজার পৃষ্ঠায় সম্পন্ন হয়েছে। এই দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থখানি ইতিপূর্বে কখনো ছাপানো হয় নাই।

৪. "নকশে হায়াত " যে গ্রন্থখানি হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানী (রা:) এর স্ব- রচিত আত্মজীবনী, এতদিন পর্যন্ত উর্দূ ভাষায়ই ছিল৷ উক্ত গ্রন্থখানি আরবী ভাষায় ভাষান্তরিত করার সৌভাগ্য মাওলানা আরশাদ মাদানীর হয়েছে।

৫. " বুরহান শরহে মাওয়াহিবুর রহমান " নামক গ্রন্থটি পরিমার্জনের কাজ করেছেন। এটি ফিকহে হানাফীয়্যার একটি দুঃস্প্রাপ্য গ্রন্থ যা মদীনা শরীফ থেকে ছেপে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আরও অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পথে রয়েছে। ইনশাআল্লাহ 

সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)'এর নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সমাজসেবা 
"মাদানী চ্যারিটেরিয়েল ট্রাষ্ট" 1997 সালে প্রতিষ্ঠা করেন৷ এ সংগঠনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ধর্মীয় পরিবেশে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু করেন৷ এই জন্য দেওবন্দে মাওলানা মাদানী মেমোরিয়াল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

এই ট্রাষ্টের অধীনে বহুসংখ্যক মাদরাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিশেষভাবে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশে আবাসিক মাদরাসা এবং অনাবাসিক মোক্তব প্রতিষ্ঠা করেন৷ পাঞ্জাবে আই,টি,আই প্রতিষ্ঠা করেন৷ মসজিদ নির্মাণ, অন্যান্য সমাজিক ও মানবিক সাহায্য- সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।


দরগাহে ইলাহীতে দু'আ করি, হে আল্লাহ ! দারুল উলূম দেওবন্দ এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দকে হযরত সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)'এর নেতৃত্বে দিন দিন উন্নতির উঁচু শিখরে পৌঁছে দিন৷ আমদের উপর সাঈয়্যেদ আরশাদ মাদানী (দাঃ)'এর ছায়াকে আর দীর্ঘ করে দিন।


No comments

Powered by Blogger.