ডানপন্থী কি? বামপন্থী কি? বামপন্থী ও ডানপন্থী রাজনীতির উৎপত্তি এবং পার্থক্য!

What is right wing? What is leftist? The origin and difference of left-wing and right-wing politics!



বিভিন্ন টকশোতে কিংবা সভা সেমিনারে প্রায়ই আমরা বলতে শুনি, অমুকে বামপন্থী রাজনীতি করেন অথবা অমুককে ডানপন্থী রাজনীতি করেন। কেউ কাউকে অপছন্দ করলে, তার গায়ে ‘কালো দাগ’ লাগিয়ে দিতে চাইলে শোনা যায়-তার নামের আগে ‘ডানপন্থী’ শব্দ বসিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।


অর্থাৎ যারা ‘ডানপন্থী’ বা ‘বামপন্থী’ কথাগুলো ব্যবহার করেন তারা বলতে চাচ্ছেন- বামপন্থী মানে ভালো আর ডানপন্থী মানে খারাপ। কিন্তু এই নামকরণ কী সঠিক? চলুন জেনে নিই, ডানপন্থী কি? বামপন্থী কি? বামপন্থী ও ডানপন্থী রাজনীতির উৎপত্তি এবং পার্থক্য! 


বামপন্থী কী?
Left-wing politics, বামপন্থী রাজনীতি হল, প্রচলিত ধর্ম, সমাজ ও গতানুগতিক বিধি বিধানের বাইরে গিয়ে রাজনীতি করা। বামপন্থী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হল সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, অগ্রগতি এবং সংস্কারের উপর জোর দেওয়া।

বামপন্থীদের আদর্শিক ভিত্তি অনুযায়ী ধর্ম এবং রাজনীতি দুইটি আলাদা বিষয়। সুতরাং তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধর্মকে আলাদা রাখে, ধর্মীয় বিষয়কে তারা প্রশ্রয় দিতে আগ্রহী নয়। সমাজতন্ত্রী ও প্রগতিশীলদেরই এখন সাধারণভাবে বামপন্থী বলা হয়। কারণ তারা ধর্মের ধার ধারে না। 


ডানপন্থী কি?
১৭৮৯ সালের ঐতিহাসিক ‘ফরাসি বিপ্লবের’ সময় যারা সংসদের ডানদিকে বসেছিল এবং যারা রাজতান্ত্রিক পুরানো শাসন বা প্রাচীন শাসনের প্রতিষ্ঠান গুলোকে সমর্থন করেছিল তাদেরকে Right-wing বা ডানপন্থী বলা হয়।

এদের প্রাচীন শাসনের আমূল পরিবর্তনের প্রতি বিরোধিতা এবং ঐতিহ্যগত সমাজ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা ছিল। ঐতিহ্য, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং অর্থনীতির বেসরকারিকরণ ডানপন্থীদের মূল মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত হত। ডানপন্থীদের সবকিছুতেই ধর্মের নিয়ম কানুন মুখ্য হয়ে থাকে।


ডানপন্থী ও বামপন্থী'র উৎপত্তি

ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লবের সময় বাম (left) শব্দটির উৎপত্তি হয়। সেই সময় পার্লামেন্টে সভাপতির ডানদিকে বসত শাসকদল, যারা অভিজাত শাসনব্যবস্থা, রাজতন্ত্র এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তথা চার্চ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সমর্থন করত। 

বাঁম পাশের আসনগুলোয় বসত বিরোধীদল, যারা বিপ্লব আর ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেছিল এবং পুরানো শাসনের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করত। বাম দিকের লোকেরা আমূল পরিবর্তন, সমাজতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ছিল অর্থাৎ রাজতন্ত্রের পরিবর্তে একটি শক্তিশালী ফরাসি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ছিল বামপন্থী দলগুলো। 


বাঁম দিকে বসার জন্য তাদের বলা হতো বামপন্থী এবং ডানদিকে বসা দলকে বলা হত ডাপন্থী। পরবর্তীকালে ফ্রান্সের অনুকরণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আইনসভায়ও বিরোধী দলের সদস্যদের বামদিকে বসার রীতি চালু হয়।


ফ্রান্সে ঐতিহ্যগত রক্ষণশীলদের নির্দেশ করতে 'ডানপন্থী' শব্দটি ব্যবহৃত হত, পরবর্তীতে ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে এই বিশেষণের অর্থ আরও বিস্তৃত হয়ে উদারপন্থী রক্ষণশীল, ঐতিহ্যগত উদারপন্থী এবং উদারবাদী রক্ষণশীল, এবং পাশাপাশি খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক এবং কিছু জাতীয়তাবাদীদের নির্দেশ করতে 'ডানপন্থী' শব্দটি ব্যবহৃত হয়।


ডানপন্থী বামপন্থী পার্থক্য

১. বামপন্থী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হল সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, অগ্রগতি এবং সংস্কারের উপর জোর দেওয়া। অন্যদিকে, ডানপন্থী রাজনীতি কর্তৃত্ব, শ্রেণিবিন্যাস, ঐতিহ্য এবং জাতীয়তাবাদের ধারণায় জোর দেওয়া।

২. বামপন্থী রাজনীতি হল প্রচলিত ধর্ম, সমাজ ও গতানুগতিক বিধি বিধানের বাইরে গিয়ে রাজনীতি করা। প্রচলিত সমাজ, ধর্ম এবং নিয়মের অনুকুলে রাজনীতি হচ্ছে ডানপন্থী রাজনীতি।


৩. বামপন্থী অর্থনীতির নীতিগুলোর মধ্যে আয়ের সমতা হ্রাস করা, ধনীদের জন্য করের হার বৃদ্ধি এবং সামাজিক কর্মসূচি এবং অবকাঠামোতে সরকারী ব্যয় জড়িত। বিপরীতে, ডান এর অর্থনৈতিক নীতিতে কম কর, সরকার দ্বারা ব্যবসার উপর কম নিয়ন্ত্রণ জড়িত।

৪. বামপন্থী রাজনীতি ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবং বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্র ও ধর্ম একে অপরের থেকে আলাদা হতে হবে (ধর্মনিরপেক্ষতা)। বিপরীতে, ডানপন্থী রাজনীতি বিশ্বাস করে যে সমাজে ধর্মের একটি প্রসারিত ভূমিকা পালন করা উচিত।

৫. বামপন্থী রাজনীতি দৃষ্টিভঙ্গিতে উদার। বিপরীতে ডানপন্থী রাজনীতি বেশি রক্ষণশীল।


অবশেষে; 
বাম ও ডান উভয়েরই উপবিভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন- চরম বাম, অতি বাম- ইংরেজিতে যা ফার-লেফট বা আল্ট্রা-লেফট করা হয়। বাংলায় সেখান থেকেই চরমপন্থী শব্দটা এসেছে। তাই আসলে বাম-ডান বলে একটা শ্রেণীকরণ আগে থেকেই আছে- এই ধরনের ধারণার ওপর ‘চরমপন্থী’ শব্দটা দাঁড়ানো। বামপন্থা ধারণাটার চরম রূপটাকে বুঝাতে এর নাম হয়েছে, ‘চরমপন্থী’ (এক্সট্রিমিস্ট)। 


একইভাবে অতি-ডান (ফার-রাইট) বা চরম ডান (আল্ট্রা রাইট)- এগুলো ডানেরই নানা উপবিভাগ। এজন্য এই চিন্তাব্যবস্থায় ডানের বেলায়- কোনো ধর্মীয় গণতন্ত্রী দল, রক্ষণশীল, জাতীয়তাবাদী ইত্যাদি হলো ডানপন্থী। এ ছাড়া রেসিস্ট বা ফ্যাসিস্টদের ‘চরম ডানপন্থী’ বলে মনে করা হয়ে থাকে। 


আবার সোশ্যালিস্ট, লিবারেল বা কমিউনিস্ট- এদের বামের উপবিভাগ বলে মনে করা হয়ে থাকে। তাই আপনার যদি রাজনীতি করা খেয়াল থাকে তাহলে এগুলো ভালো ভাবে বুঝে নেবেন। গতানুগতিক ধারায় রাজনীতি করার দিন একেবারেই শেষ। 









No comments

Powered by Blogger.