ইসলামে দাড়ির বিধান ও গুরুত্ব এবং সঠিক নিয়ম

ইসলামে দাড়ির বিধান | গুরুত্ব | সঠিক নিয়ম |



ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। মানুষের জন্য কল্যাণকর সবকিছুকে ইসলামে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে আবার অকল্যাণকর বা ক্ষতিকর সবকিছুকে অস্বীকৃতি বা নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামী শরিয়তের সবকিছুই পবিত্র কোরআন ও হাদীসের ওপর নির্ভরশীল। পবিত্র কোরআনে যা কিছু বলা হয়েছে তার সবকিছুই মহান আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে আর মহান আল্লাহর সকল আদেশই ফরজ এবং যা হাদীসের মাধ্যমে এসেছে তা কিছু সময় ওয়াজিব আবার কিছু সময় সুন্নাত।


অর্থাৎ ওয়াজিব হচ্ছে সেই সমস্ত কাজ যেগুলো করার প্রতি নবী কারীম (সা.) এর আদেশ রয়েছে বা যেগুলো পালন করার প্রতি বেশি জোর দেয়া হয়েছে আর সুন্নাত হচ্ছে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) যা করতেন সেই সব কাজ। একজন মুসলিম হিসেবে এর সবকিছুই আমাদের করণীয়।


দাড়ির বিধান
দাড়ির আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে লিহইয়াহ। এই শব্দটি ‘লাহি’ বা চোয়াল থেকে আগত। চোয়াল তথা গালে গজানো চুলকেই মূলত দাড়ি বলা হয়। নিচের ঠোঁটের নিচে, চিবুকে ও চোয়ালের নিচের অংশে উৎপন্ন চুলও এর অন্তর্ভুক্ত।
দাড়ি পুরুষদের মুখমন্ডলের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ। গুরুত্ত্বপূর্ণ বলার কারণ হচ্ছে দাড়ি রাখা বা না রাখার ইসলামিক ও বৈজ্ঞানিক উপকারী ও ক্ষতিকর উভয় দিক রয়েছে। যা আজ আমরা আমাদের আলোচনায় তুলে ধরবো।


পুরুষদের মুখমন্ডলে দাড়ি রাখা মুসলিমদের এক গুরুত্বপূর্ণ চিন্হ যা তার মুসলমান হওয়ার পরিচয় বহন করে। দাড়ি রাখা ফরজ, ওয়াজিব নাকি শুধুই সুন্নাত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তার জীবনে যা করতেন অর্থাৎ তার কর্মপন্থাই মূলত সুন্নাত হিসেবে পরিগণিত। সেই দিক থেকে দাড়ি রাখা অবশ্যই সুন্নাত এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 


সূরা হাশরের একটি আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ,
‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সূরা হাশর, আয়াত:৭)


■ দাড়ির গুরুত্ব ।
সাধারণ মুসলমানদের অনেকেই মনে করে থাকেন, দাড়ি রাখা হচ্ছে সুন্নত, অতএব দাড়ি রাখলে ভাল আর না রাখলে তেমন কোনো সমস্যা নেই। একটা সুন্নত পালন করা হলো না, এই আর কি! আসলে এটা সম্পূর্ণই একটি ভুল ধারণা। দাড়ি রাখা কোনো অর্থে সুন্নত আর কোনো অর্থে ফরজ বা ওয়াজিব আগে সেটা বুঝতে হবে। 

ইসলামে শর’ঈ বিধানের প্রধান সূত্র হচ্ছে কোরআন ও রাসুলের (সা.) সুন্নাহ অর্থাৎ হাদিস।পবিত্র কোরআনে আল্লাহতা’আলা যে সব বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন ও নিষেধ করেছেন তা পালন করা আমাদের ওপর ফরজ। এবার আসুন, দাড়ি রাখা কোন অর্থে সুন্নত আর কোন অর্থে ফরজ বা ওয়াজিব সেটা জানার ও বোঝার চেষ্টা করি।


■ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে দাড়ির গুরুত্ব ।
পবিত্র কোরআন মাজীদে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন,
‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।’ সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১

হাদীস শরীফে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘দশটি বিষয় সকল নবী-রাসূলগণের সুন্নাত। তন্মধ্যে গোঁফ ছোট করা এবং দাড়ি লম্বা করা অন্যতম।’ (সহীহ মুসলিম শরীফ: ১/১২৯) এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে নবীর সুন্নাত হিসেবে দাড়ি রাখার গুরুত্ব অনেক।


ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, তোমরা মুশরিকদের বিপরীত করবে- দাড়ি লম্বা রাখবে, গোঁফ ছোট করবে। (সহীহ বুখারি, হাদিস নং–৫৪৭২)


দাড়ি রাখার সঠিক নিয়ম 
যারা ইসলামকে ভালভাবে উপলব্ধি করারবাস্তব জীবনে ইসলাম মেনে চলা শুরু করেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছেন। দাড়ি রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করে দাড়ি রাখাও শুরু করেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অনেক মুসলিম ভাই দাড়ি রাখার সঠিক পদ্ধতিটি জানেন না।
ফলে তারা দাড়ি রাখতে গিয়ে অনেক ভুল পদ্ধতিতে জড়িয়ে পরেন।

সেগুলো হচ্ছে- দাড়ি ছাটাই করে রাখা, দাড়ি সমান করে রাখা, গালের উপরে ক্ষুর চাঁছাই করা, গোঁফ ক্ষুর দিয়ে চাঁছাই করা ইত্যাদি। দাড়ির ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর স্পষ্ট নির্দেশ হ’ল, তোমরা দাড়ি ছেড়ে দাও ও গোঁফ ছাটো এবং মুশরিকদের বিপরীত কর’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৪২১)।


আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ) বলেছেন- তোমরা মুশরিকদের বিপরীত কর,দাড়ি বাড়াও এবং গোফ ছোট কর। [সহিহ বুখারী, ৯ম খন্ড, পোশাক অধ্যায়,হাদিস-৫৪৭৩]
এরকম আরো বহু হাদিসরয়েছে যেখানে আল্লাহ রাসুল (সাঃ)বলেছেন দাড়ি ছেড়ে দাও,দাড়ি বাড়াও, দাড়ি লম্বা কর।পক্ষান্তরে দাড়ি ছাঁটাই করার কোন
প্রমান নেই, একটি ছাড়া। সেটি হল-আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হজের মৌসুমে দাড়ি মুট করে ধরে নিচেরঅতিরিক্ত অংশটুকু কেটে ফেলতেন।
[সহিহ বুখারী, ৯ম খন্ড, পোশাক অধ্যায়,হাদিস-৫৪৭২]

এই হাদিস গুলো থেকে স্পস্টকরে প্রমানিত হয় যে দাড়ি বাড়াতে হবে অর্থাৎ বড় রাখতে হবে। উপরে-নিচে ছাঁটাইকরা যাবে না। তাই কেউ যদি একান্তই দাড়ি ছোট করতে চায় তবে সেটা এক মুষ্টির পরে। তাই কেউ যদি দাড়ি রাখার পর কাট-ছাঁট করে রাখে তাহলে আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ)-এর অনুসরণ করল না। দাড়িকে কাট-ছাঁট করা সুন্নাত নয়। বরং এটি সুন্নাতের বিপরীত। দাড়িকে এভাবে কাট-ছাঁট করে রাখা বিদআত। চিন্তা করে দেখুন, কোন ভাই দাড়ি রাখছে নেকির জন্য। অথচ সে কোন নেকিই পাবে না। 

কেউ যদি দাড়িকে কাট-ছাঁট করে বলে যে, আমি সুন্নাত পালন করছি, তাহলে সেটা হবে মিথ্যা কথা, কারনআল্লাহ্র রাসুল (সাঃ) এমনদাড়ি রাখেন নি, সাহাবাগনও এমন ছাঁটাই করা দাড়ি রাখেন নি। তাই সে ধরণের ছাঁটাই করা রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাত নয়, রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাত নয় সেটাকে জোর করে সুন্নাত বলা মহা অন্যায়।আমি সকলকে আহ্বান করব, আসুন আমরা সবাই আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ) এর আসল সুন্নাতের অনুসরণ করি।


পারস্য সম্রাট কিসরা ইয়েমেনের শাসকের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে দু’জন দূত পাঠান। এদের দাড়ি ছিল কামানো আর গোঁফ ছিল বড়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে তাদের এই অবয়ব এতই কুৎসিত লেগেছিল যে, তিনি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তোমাদের ধ্বংস হোক, এমনটি তোমাদের কে করতে বলেছে? তারা উত্তর দিল, আমাদের প্রভু কিসরা। তিনি (সা.) তখন উত্তর দেন, আমার রব, যিনি পবিত্র ও সম্মানিত- আদেশ করেছেন যেন আমি দাড়ি ছেড়ে দেই এবং গোঁফ ছোট রাখি। (ইবনে জারির আত তাবারি, ইবন সা’দ ও ইবন বিশরান কর্তৃক নথিকৃত। আলবানি (রহ.) একে হাসান বলেছেন। দেখুন আল গাযালির ফিক্বহুস সিরাহ ৩৫৯ পৃষ্ঠা)


■ দাড়ি সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান ।
দাড়ি অথবা চুল পেকে সাদা হয়ে গেলে সেটাকে সাদা রাখা নিষেধ। সেটাকে সাদা না রেখে কালো রং ব্যতীত অন্য যে কোন রং দ্বারা রাঙিয়ে ফেলতে হবে।
রাসুল (সাঃ) বলেনঃ ইয়াহুদ ও নাসারারা (চুল ও দাড়িতে) রং লাগায় না। সুতরাং তোমরা তাদের বিপরীত করবে। (সহিহ বুখারী, ৯ম খন্ড, পোশাক অধ্যায়,হাদিস নং ৫৪৭৮)


তাই এটা খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ। দাড়ি অথবা চুল পেকে সাদা হয়ে গেলে সেটাকে সাদা না রেখে কালো রং ব্যতীত অন্য যে কোন রং দ্বারা রাঙিয়ে ফেলতে হবে।
উল্লেখ্য যে কালো রং কোনমতেই লাগানো যাবে না।
কেননা কালো রং লাগানো কিয়ামতের আলামত।
নাবী (সাঃ) বলেছেন-শেষ যামানায় একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা সাদা চুল-দাড়ি কালো রঙ দিয়ে রাঙাবে। তারা জান্নাতের গন্ধও পাবে না।
(আবু দাউদ, পৃষ্ঠা-৮৪)


এইক্ষেত্রে বর্তমান মুসলিমরা কোন পরোয়া করে না। তারা হয় চুল-দাড়ি সাদাই রেখে দেয় নতুবা কালো রঙ দিয়ে কলপ করে। অথচ দুটোই হারাম। 


আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম - কে বলতে শুনেছি মানুষের ফিতরাত (প্রকৃতিগত স্বভাব) পাঁচটি:
【1】 খাতনা করা।
【2】 (নাভীর নীচের লোমে) ক্ষুর ব্যবহার করা ।
【3】 গোঁফ ছোট করা।
【4】 নখ কাটা।
【5】 বোগলের পশম কেটে ফেলা।
সহিহ বুখারী, ৯ম খন্ড, পোশাক অধ্যায়,হাদিস নং ৫৪৭১



No comments

Powered by Blogger.